ক্যালিব্রেশন কী এবং কেন
পৃথিবীতে বর্তমান সময়ে ত্রুটিপূর্ণ, ত্রুটিযুক্ত পণ্যের কোন স্থান নেই। ধরুন একজন একই কোম্পানির দুটি আলাদা ব্যাচের দুটি প্যাকেটের বিস্কিট দুরকম স্বাদ লাগল। আপনি সম্ভবত এই কোম্পানিকে আর ভরসা করবেন না। এই যে স্বাদে তারতম্য তার একটা কারণ হতে পারে যে ওয়েইট স্কেল দিয়ে উপকরণ মাপা হয়েছিল সেটা সঠিক মাপ না দেওয়ায় উপকরণের তারতম্য হয়েছে।
এই যে ওয়েইট স্কেলটা সঠিক মাপ দিচ্ছে কিনা তা আমরা জানব কীভাবে? ক্যালিব্রেশনের মাধ্যমে। আর তাই ক্যালিব্রেশন কী এবং কেন তা জানা দরকার ।
শুধু ওয়েইট স্কেল নয়, পরিমাপক অন্যান্য সব মেশিনের পাঠ ঠিক আছে কিনা সেটা নিশ্চিত করার পদ্ধতির নাম ক্যালিব্রেশন। মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদনের জন্য পরিমাপক যন্ত্রগুলোর নির্ভুলতা প্রয়োজন। আর যন্ত্রগুলোর যান্ত্রিক বা পরিমাপের ত্রুটি নির্ণয় করা এবং সেটাকে অ্যাডজাস্ট করার জন্য দিকনির্দেশনা দেয় ক্যালিব্রেশন।

যে কোন ধরনের শিল্প কারখানা, ল্যাবরেটরি অথবা ফার্মাসিটিক্যাল বা কেমিক্যাল, সবখানেই অডিটিং এবং কমপ্লায়েন্সের অংশ হচ্ছে ক্যালিব্রেশন।
ক্যালিব্রেশন কী এবং কেন দরকার?
সংজ্ঞা আনুসারে, ক্যালিব্রেশনহচ্ছে এমন কার্যক্রম, যা সুনির্দিষ্ট পরিবেশে পরিমাপ থেকে প্রাপ্ত মান ও পরিমাপের অনিশ্চয়তার মাঝে সম্পর্ক তৈরি করে এবং এ তথ্যের মাধ্যমে পরিমাপের ফলাফল পেতে সাহায্য করে।
মূলত, ক্যালিব্রেশন হচ্ছে পরিমাপ তুলনা করার একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে কিনা তা বোঝা যায়। একটি যন্ত্রের নির্ভুলতা বজায় রাখার প্রক্রিয়াটিকে ক্যালিব্রেশন হিসেবে অবহিত করা হয়। ক্যালিব্রেশন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে যন্ত্র, মিটার, মেশিন বা ডিভাইসের ফলাফল সন্তোষজনক পর্যায়ে হচ্ছে কিনা তা বোঝা যায়। যে সকল কারণগুলোর ফলে ভুল হচ্ছে, সেগুলোকে কমাতে বা দূর করার জন্য ক্যালিব্রেশন আমাদের প্রয়োজন।

কখন মেজারমেন্ট যন্ত্রগুলির নির্ভরযোগ্যতা কমতে থাকে?
নিয়মিত ব্যবহারের কারণে দিনদিন মেজারমেন্ট যন্ত্রগুলির নির্ভরযোগ্যতা কমতে থাকে। এজন্য যন্ত্রপাতিগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন এবং তা রেফারেন্সের মান অনুসরন করে পরীক্ষা করতে হবে, যেন আমরা বুঝতে পারি যে যন্ত্রটি দ্বারা প্রদর্শিত মেজারমেন্ট সম্পূর্ণরূপে সঠিক আছে কি না।
যেমন- যখন আমরা একটি থার্মোমিটার ক্যালিব্রেশন করি, তখন এর ভুল মাপ দেখানো বা অন্যান্য ত্রুটি কে সংশোধন বা নির্দিষ্ট করে ঠিক করা সম্ভব।
এরপর থার্মোমিটারটি সেলসিয়াস অনুসারে সঠিক তাপমাত্রা দেখাবে বা ক্যালিব্রেশনের ফলাফল অনুসারে ম্যানুয়ালি একে ঠিক করতে হবে। ফলে, চূড়ান্ত ফলাফল সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য হবে।
ক্যালিব্রেটর এর প্রকারভেদ
- মেজারমেন্টের যন্ত্রপাতি অনুসারে অনেক ধরনের ক্যালিব্রেটর রয়েছে যেমন-
- টেমপারেচার ক্যালিব্রেটর,
- ইলেক্ট্রিক্যাল ক্যালিব্রেটর,
- ডেড ওয়েট ক্যালিব্রেটর,
- টর্ক-রেঞ্চ ক্যালিব্রেটর,
- লোড সেল ক্যালিব্রেটর ইত্যাদি।
কেন ক্যালিব্রেশন প্রয়োজন?
- একটি প্রতিষ্ঠানের সাকসেস এর জন্য মেজারমেন্ট নির্ভুল ও সঠিক হওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কাঁচামালের পরিমাণ, উৎপাদনের অবস্থা, পণ্যের ফলাফলের গুণমান পরীক্ষা, প্রতিটি ছোট পদক্ষেপের জন্য একাধিক উপাদান মেজারমেন্টের জন্য একাধিক যন্ত্রের প্রয়োজন। ক্যালিব্রেশন সার্ভিস নিশ্চিত করে এই যন্ত্রগুলি সঠিকভাবে কাজ করছে কি না।
সরঞ্জামগুলিতে একটি ছোট ত্রুটির কারণে পুরো প্রক্রিয়াটি পুনরায় চালু করতে অনেক সময় লাগে। ক্যালিব্রেশন নিশ্চিত করে যে, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মেজারমেন্ট ইউনিটের সাথে এর মিল রয়েছে।
অনুগ্রহ করে চিত্রটি খেয়াল করুন-

চিত্রটিতে দেখা যাচ্ছে সঠিকভাবে ক্যালিব্রেশন করার ফলে, একটি যন্ত্রের বা ডিভাইসের প্রোডাকশন ও প্যারফর্মেন্স বৃদ্ধি পেয়েছে। উৎকৃষ্ট পণ্যের পরীক্ষার ফলাফল হবে “আদর্শ ফলাফল” হিসাবে লেবেল করা নীল রেখার কাছাকাছি। ক্যালিব্রেশন সুবিধা ব্যতিত মেশিন রিডিং এ বড় ধরনের ভুল থাকতে পারে।
লাল বিন্দুযুক্ত রেখার মানে হচ্ছে পরীক্ষামূলক ফলাফলে বড় ধরনের ভুল রয়েছে; যা আদর্শ ফলাফল থেকে অনেক দূরে। যেখানে ক্যালিব্রেশন করার পর, পরীক্ষা যন্ত্রের ফলাফলে তেমন কোন ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
আইএসও ৯০০১ঃ২০১৫ এর ধারা-৭.১.৫.২ মেজারমেন্ট ট্রেসেবিলিটি এর উপধারা-(এ) অনুসারে; শিল্প বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব সকল মনিটরিং ডিভাইস, যেমনঃ প্রেশার গেজ, থার্মোমিটার, মাইক্রোমিটার, ভার্নিয়ার স্কেল, ভোল্টমিটার, প্রেশার গেজ ও ট্রান্সমিটার; ডেডওয়েট টেস্টার, ওয়েট বালেন্স, ওয়েট স্কেল, মেসারিং সিলিনডার, মেসারিং টেপ; ইত্যাদির প্যারফর্মেন্স, ক্যালিব্রেশন ও ভেরিফিকেশন যাচাই। ক্যালিব্রেশন ও ভেরিফিকেশনের মাদ্ধমে; মেশিনের প্যারফর্মেন্স ভালো থাকে এবং মেশিনের দীর্ঘায়ুর ফলে প্রডাকশন ভালো হয়। এ জন্য ক্যালিব্রেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিটি অডিটের (যেমন, আইএসও ৯০০১ অডিট, আইএসও/আইইসি ২৭০০১ অডিট, আইএসও ১৪০০১ অডিট,আইএসই ৪৫০০১ অডিট, আইএসও/আইএসই ১৭০২৫ অডিট, আইএসও/আইএসই ১৭০২০ অডিট, আইএসও ২২০০০ অডিট, আইএসও ২৭০০১ অডিট, আইএসও ২৮০০১ অডিট, আইএসও ৫০০০১ অডিট, আইএসও ১৪০৬৪ অডিট, বায়ার অডিট, টেকনিক্যাল অডিট, কমপ্লায়েন্স অডিট ইত্যাদি) ক্ষেত্রে ক্যালিব্রেশন ডকুমেন্ট অবশ্যই দেখাতে হবে।
কখন ক্যালিব্রেশন সার্ভিস নিতে হবে
যখন নতুন কোন যন্ত্র কেনা হয়; তার পরিমাপ স্ট্যান্ডার্ড পরিমাপক অনুযায়ী সঠিক কিনা তা বোঝার জন্য শুরুতেই ক্যালিব্রেশন করে নিতে হয়। কিছু ক্ষেত্রে; বিক্রেতাই এই ক্যালিব্রেশনটি করে দিয়ে থাকে।
দ্বিতীয়ত, একটি যন্ত্র মেরামত করার পর তা পুনরায় পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয়।
তৃতীয়ত, কোন যন্ত্র এক স্থান থেকে আরেক স্থানে বারবার নেবার সময় তা নষ্ট হতে পারে; সমস্যা দেখা দিতে পারে। সে সময়ই ক্যালিব্রেশন করাতে হয়।
চতুর্থত, নির্দিষ্ট সময়কাল অতিবাহিত হবার পর যন্ত্রটি ক্ষয় হয় বা ভুল পরিসংখ্যান দেখায়। তখনও ক্যালিব্রেশন ও রিপেয়ার সার্ভিসের প্রয়োজন হয়।
অনেক সময়, নির্দিষ্ট অপারেশন ঘণ্টা অতিবাহিত হবার পর ক্যালিব্রেশন ও ক্যালিব্রেশন এক্সপার্টের প্রয়োজন দেখা দেয়।
গুরুত্বপূর্ণ মেজারমেন্টের আগে বা পরে ভবিষ্যতে কোন ত্রুটি এড়ানোর জন্য ক্যালিব্রেশন করতে হতে পারে।
কোনো পরিমাপন যন্ত্র আঘাত পেলে, উপর থেকে পড়ে গেলে; এর আভ্যন্তরীন যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। এ সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে; যন্ত্রটি ক্যালিব্রেশন করে নিশ্চিত হওয়া যন্ত্রটি ঠিক পরিমাপ দিচ্ছে কিনা।
অনেক সময়, নির্দিষ্ট কোন প্রয়োজনে বা পরামর্শ অনুসারে ক্যালিব্রেশন সার্ভিসের প্রয়োজন হতে পারে।